যখন শিরিনের সরাসরি কানের নীচে এম-১৬ বুলেট দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন তিনি প্রেস হেলমেট পরিহিত ছিলেন না-এটি থেকে সহজেই অনুমেয় যে, এলোপাতাড়ি গুলিতে নয়; বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই তাকে হত্যা করা হয়েছে
যখন শিরিনের সরাসরি কানের নীচে এম-১৬ বুলেট দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন তিনি প্রেস হেলমেট পরিহিত ছিলেন না-এটি থেকে সহজেই অনুমেয় যে, এলোপাতাড়ি গুলিতে নয়; বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই তাকে হত্যা করা হয়েছে
গত চুয়াত্তর বছর ধরে প্রতিদিনই অসংখ্য ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ, যুবক এবং বৃদ্ধ আত্মাহুতি দিয়ে আসছেন।
তবে, এতো ক্ষতি এবং বিয়োগান্তক ঘটনার মধ্যেও গতকাল শিরিন আবু আকলেহের হত্যাকাণ্ড এক অন্যরকম অনুভূতি, বেদনা এবং শোকের জন্ম দিয়েছে।
তার মৃত্যু আমাদের বাকরুদ্ধ করেছে, আমাদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে এবং আমাদের চোখের জল ঝরিয়েছে। শুধুমাত্র এই কারণেই নয় যে, শিরিন তার কাজের জন্য নিবেদিত ছিলেন, বরং তিনি ছিলেন সাহসিকতা এবং ত্যাগের প্রতীক।
আল জাজিরার পর্দায় শিরিনের প্রতিবেদনগুলো তার জীবনঘাতী বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী ছিল।
ফিলিস্তিনি ভূমিতে যখনই ইসরায়েলি দখলদারিত্বের দাম্ভিকতা তীব্র হয়েছে – তখনই সেখানে শিরিনকে পর-মুহুর্তে বিশ্বের কাছে খবর পৌঁছে দিতে দেখা গেছে। কোনো কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
তার কথা আমাদের আশা জাগিয়েছে এবং একইসঙ্গে বেদনাবিধূর করেছে।
ADVERTISEMENT
ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্দশার কথা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার বাগ্মীতা শিরিন কোথা থেকে পেয়েছিলেন তা আমি জানি না। তবে তার উচ্চারণ দর্শক হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল, একই সঙ্গে ক্ষুব্ধ করেছিল দখলদারদের।
সর্বশক্তিমান আল্লাহ শিরিনের ওপর রহমত বর্ষণ করুন এবং তাকে জান্নাতবাসী করুন।
শিরিন একবার বলেছিলেন, “আমাদের সাথে ক্যামেরা থাকতো যখন আমরা মিলিটারি চেকপয়েন্ট আর পেছনের দিকের রাস্তাগুলো দিয়ে চলাচল করতাম। বাস্তবতা বদলানো আমার পক্ষে সহজ নয়, তবে আমি যা করতে পারি তা হল আমাদের কণ্ঠস্বর বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তেও মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছি। আমি শিরিন আবু আকলেহ।”
এটা সত্য যে আমরা শিরিনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আল জাজিরার মাধ্যমে আমাদের ঘরে এবং আমাদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন।
যখন শিরিনের কানের নীচে সরাসরি এম-১৬ বুলেট আঘাত করে, তখন তিনি প্রেস হেলমেট পরা ছিলেন না। এটি থেকে সহজেই অনুমেয় যে, এলোপাতাড়ি গুলিতে নয়; বরং ইচ্ছাকৃতভাবেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
ইসরায়েলি বর্ণনা, যেটিকে আমি উপন্যাস বলব; যা ইতোমধ্যে চারবার পরিবর্তিত হয়েছে, সেটি এই জঘন্য অপরাধে ইসরায়েলের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দেয়।
এখানে বলে রাখা ভালো, ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজের সর্বশেষ সংস্করণ নিশ্চিত করেছে, শিরিন এবং আল জাজিরার ক্রুরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার মাত্র ১৫০ মিটার দূর থেকে ইসরায়েলি কমান্ডো ইউনিট ডোভডোভান গুলি চালায়।
সমগ্র বিশ্ব এই জঘন্য অপরাধের নিন্দা করেছে, এমনকি মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরাও শিরিন আবু আকলেহ’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছেন।
এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়- শিরিন কেবল ফিলিস্তিনি জনগণ এবং আরব বিশ্বের চোখেই নয়, সারাবিশ্বে তিনি মর্যাদাপূর্ণ এবং সম্মানজনক অবস্থান অর্জন করেছিলেন।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি রয়ে গেছে, সেটি হলো- যারা এই শহীদের আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার জন্য নীরবে দাঁড়িয়েছিলেন তারা কি নির্বিচারে ফিলিস্তিনি জনগণকে হত্যা এবং আমাদের ওপর বর্বোরোচিত হামলা বন্ধের দাবি জানাবেন, নাকি তাদের বিবেক এক মিনিট নীরবতা প্রকাশেই সন্তুষ্ট থাকবে?
আগামী দিনগুলো পথ নির্ধারণ করে দেবে, আমরা অপেক্ষা করব এবং দেখব।
আপনার ওপর সৃষ্টিকর্তার রহমত বর্ষিত হোক শিরিন আবু আকলেহ।
আপনার চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপূরণীয়, এই ক্ষতি আমাদের বয়ে যেতে হবে এবং যা আমাদের হৃদয়ের গভীরে থাকবে।
আপনি আপনার কথা দিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি জীবিত বিবেকের চোখে অশ্রু ঝরিয়েছেন।
আপনার স্মৃতি আমাদের এবং আগামী প্রজন্মের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
ইউসুফ রামাদান
বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত
Leave a Reply