বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাস প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত :
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজনৈতিক ইতিহাসের মতো নির্দিষ্ট সালতারিখ অনুযায়ী সাহিত্যের ইতিহাসের যুগ বিভাজন করা সম্ভব নয়। যদিও সাহিত্যের ইতিহাস সর্বত্র সালতারিখের হিসেব অগ্রাহ্য করে না। সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে নির্দিষ্ট যুগের চিহ্ন ও সাহিত্যের বিবর্তনের ধারাটি বিশ্লেষণ করেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করা হয়ে থাকে।
বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের পূর্বে বাংলায় সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অবহট্ঠ ভাষায় সাহিত্য রচনার রীতি প্রচলিত ছিল। এই সাহিত্যের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের আদি অধ্যায়ের সূচনা হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি আক্রমণের বহু পূর্বেই বাঙালিরা একটি বিশেষ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উন্মেষ ঘটে বাংলা ভাষারও। তবে প্রথম দিকে বাংলায় আর্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেনি। সংস্কৃত ভাষায় লেখা অভিনন্দ ও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন, উমাপতি ধরের কাব্যকবিতা, জয়দেবের গীতগোবিন্দম্, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় ও সদুক্তিকর্ণামৃত নামক দুটি সংস্কৃত শ্লোকসংগ্রহ; এবং অবহট্ঠ ভাষায় রচিত কবিতা সংকলন প্রাকৃত-পৈঙ্গল বাঙালির সাহিত্য রচনার আদি নিদর্শন। এই সকল গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত না হলেও সমকালীন বাঙালি সমাজ ও মননের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীকালের বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যে গীতগোবিন্দম্ কাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য।
বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত চর্যা পদাবলি ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত। আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণ বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে চর্যার ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কয়েকটি পদ কালজয়ী।
মধ্যযুগ ১২০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। মধ্যযুগের প্রথম উল্লেখযোগ্য র্নিদর্শন বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। আনুমানিক চৌদ্দ শতকের শেষার্ধে বা পনেরো শতকের প্রথমার্ধে বড়ু চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি অবলম্বনে এ কাব্য রচনা করেছিলেন । এ সময় মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমবিষয়ক পদ রচনা করেছিলেন। মধ্যযুগের প্রথম মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগীর পঞ্চদশ শতকে প্রণয়োপখ্যান জাতীয় কাব্য “ইউসুফ-জোলেখা” রচনা করেন। এর বাইরে অনুবাদসাহিত্য মধ্যযুগের অনেকখানি অংশজুড়ে আছে। এ ধারার সূত্রপাত হয় কবি কৃত্তিবাস কর্তৃক রামায়ণের বঙ্গানুবাদের মাধ্যমে। পরবর্তীতে বাংলায় আরও অনূদিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। মধ্যযুগের বিশাল পরিসর জুড়ে ছিলো মঙ্গলকাব্য। দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক এই কাব্যধারার সূত্রপাত হয় পনের শতকে। তবে ষোল শতকে এর সর্বাধিক প্রসার ঘটে। ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শিবমঙ্গল বা শিবায়ন, চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদি এ পর্যায়েরই নানা শাখা। এই ধারার অন্যতম কবি মাণিক দত্ত, কানাহরি দত্ত, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর প্রমুখ। শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবের ফলে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ সমৃদ্ধির পথে অনেকখানি এগিয়ে যায়। মধ্যযুগেই আরাকানের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয়। এছাড়া শাক্ত পদাবলী, নাথসাহিত্য, বাউল ও অপরাপর লোকসঙ্গীত, ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ-গীতিকা ইত্যাদি মধ্যযুগেরই সৃষ্টি।
বাংলা সাহিত্যের ১২০১-১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কে “অন্ধকার যুগ”। হুমায়ুন আজাদ তার “লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী” গ্রন্থে (পৃষ্ঠা নং- ১৭) লিখেছেন- “১২০১-১৩৫০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত উল্লেখযোগ্য কোন সাহিত্য কর্ম পাওয়া যায়নি বলে এ-সময়টাকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। পণ্ডিতেরা এই-সময়টাকে নিয়ে অনেকবার ভেবেছেন, এবং অনেকবার আলোচনাও করেছেন, কিন্তু কোন পন্ডিত অন্ধকার সরিয়ে ফেলতে পারেন নি ।এ- সময়টির দিকে তাকালে তাই চোখে কোন আলো আসেনা, কেবল আঁধার ঢাকা চারদিক।” কিন্তু, ওয়াকিল আহমদ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত’ (পৃ. ১০৫)-এ লিখেছেন- “বাংলা সাতিহ্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম -শিক্ষা শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে, কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না থাকার এটাই মুখ্য কারণ।”
এসময়ের সাহিত্য নিদর্শন :
১. প্রাকৃত ভাষায় রচিত গীতি কবিতার সংকলিত গ্রন্থ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’
২. রামাই পণ্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ (গদ্যপদ্য মিশ্রিত)
৩. হলায়ুধ মিশ্রণে রচিত ‘সেক শুভোদয়া’ (গদ্যপদ্য মিশ্রিত)
৪. ডাক ও খনার বচন
‘নিরঞ্জনের উষ্মা’ শূন্যপুরাণ এর একটি কবিতা ।
মূলত বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগ নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও,মোটামুটি ভাবে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে নানা সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন। কালের দিক থেকে
আধুনিক যুগকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায় :-
১৭৬০-১৭৯৯খ্রিঃ(আধুনিক যুগ, প্রথম পর্ব) ১৮০০-১৮৫৮খ্রিঃ(আধুনিক যুগ, দ্বিতীয় পর্ব) ১৮৫৯-১৯০০খ্রিঃ(আধুনিক যুগ, তৃতীয় পর্ব) ১৯০১-১৯৪৭খ্রিঃ(আধুনিক যুগ, চতুর্থ পর্ব) ১৯৪৮-২০০০খ্রিঃ(আধুনিক যুগ, পঞ্চম পর্ব) ২০০১খ্রিঃ- বর্তমানকাল(আধুনিক যুগ, ষষ্ঠ পর্ব) (চলবে….)
বিষয় : বাংলা সাহিত্য
বেতনা নিউজ ২৪ /সা/ডে/
Leave a Reply