অনলাইন ডেস্ক,
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ১৯তম ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বরাবরের মতই মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন তিনি । নিউ ইয়র্ক সময় শুক্রবার বিকালে (বাংলাদেশ সময় ২৪ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায়) তিনি বক্তব্য দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বছরের সাধারণ বিতর্কের প্রতিপাদ্য, একটি সঙ্কটপূর্ণ সন্ধিক্ষণ: আন্তঃসংযুক্ত প্রতিকূলতাসমূহের রূপান্তরমূলক সমাধান। সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলা এবং আমাদের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে শান্তিপূর্ণ ও টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলার উপায় খুঁজে বের করার জন্য সকলের ঐক্যবদ্ধ আকাঙ্ক্ষার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারির মারাত্মক প্রভাব বিশ্ব যখন সামলে উঠতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিশ্বকে নতুন করে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, জ্বালানি এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার বিষয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বৈরীপন্থা কখনও কোন জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। পারস্পরিক আলাপ-আলোচনাই সঙ্কট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ গঠন করায় জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানাই। এই গ্রুপের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে, আমি বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব ও সঙ্কটের গভীরতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বৈশ্বিক সমাধান নিরূপণ করতে অন্যান্য বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির শুরু থেকে এ সঙ্কট মোকাবেলায় আমরা মূলত তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে কৌশল নির্ধারণ করেছি। প্রথমত, মহামারি সংক্রমণ ও বিস্তাররোধ করতে আমরা জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত করেছি। দ্বিতীয়ত, আমাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে কৌশলগত আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করেছি এবং তৃতীয়ত, আমরা জনগণের জীবিকা সুরক্ষিত রেখেছি। এসব উদ্যোগ মহামারিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস করার পাশাপাশি মানুষের দুর্ভোগ কমাতে সাহায্য করেছে। মহামারি থেকে আমাদের নিরাপদ উত্তরণের মূলচাবি কাঠি হলো টিকা। এই টিকা সরবরাহের জন্য আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এর কোভ্যাক্স ব্যবস্থা এবং আমাদের সহযোগী দেশগুলোকে ধন্যবাদ জানাই।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বে এর প্রভাব তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত এবং জ্বালানি, খাদ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে আমাদের মত অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। মুল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছি।
মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর ভাঙার একটি দুষ্টচক্র আমরা অতীতে দেখেছি। আমাদের এখনই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কিত আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা এবং নীতিগুলো জেন্ডার সংবেদনশীল করে তৈরি করা হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণয়ণে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত আছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানাই।
তিনি আরও বলেন, অভিবাসীরা এখনও তাদের অভিবাসন যাত্রায় অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্তমানে এসব জটিল বৈশ্বিক সঙ্কট অনেক উন্নয়নশীল দেশের বিগত কয়েক দশকের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে স্থবির করে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে ২০৩০-এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা তাদের অনেকের কাছেই একটি অধরা স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং কৃষিসহ মারাত্মভাবে প্রভাবিত ক্ষেত্রগুলোতে সুনির্দিষ্ট সহায়তা প্রয়োজন।
শিক্ষা, নারী, শিশু ও সামাজিক উন্নয়ন খাতে সরকারগৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। উন্নত ভৌত অবকাঠামো গঠনে পদ্মা বহুমুখী সেতু এবং চলমান মেগাপ্রকল্পগুলোর বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করার জন্য এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও জলবায়ু-সহিষ্ণু বদ্বীপে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির পর সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে আমাদের সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বব্যাপী অংশীজনদের সঙ্গে একযোগে কাজ করার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করি। সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য সমুদ্র আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘের কনভেনশনের বিধানগুলির কার্যকর বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
২০১৯ সালে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ বিষয়ক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তাররোধসহ সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ধারাবাহিকভাবে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আমাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে আসছি। আমাদের শান্তি-কেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সৈন্য ও পুলিশ প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে আমরা বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছি।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দুরূহ করে তুলেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৭ সালে স্বদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানবপাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চেয়ে তিনি বলেন, আমরা নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শান্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেওয়া হয়। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সকল মানুষের জীবন-জীবিকা মহাসঙ্কটে পতিত হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে, শিশুরাই বেশি কষ্ট ভোগ করে। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে যায়। বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার আবেদন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ ও স্যাংশন বন্ধ করুন। শিশুকে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা দিন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ মানুষ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনকে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সময় তার পরিবারের দুঃসহ অবস্থার বর্ণনা দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডপরবর্তী নির্বাসিত জীবনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা-কু-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারি। তাই যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই ।
বিভাগ : জাতীয়
বেতনা নিউজ ২৪ /অ/ডে/
Leave a Reply