সিলেট অঞ্চলে হঠাৎ বন্যায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। এবারের বন্যা এতো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেল স্টেশন, এয়ারপোর্ট সবই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। পুরো সিলেট শহর এখন পানির নিচে। সুনামগঞ্জ জেলার অবস্থা এখন ভয়াবহ, সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার সব কয়টি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎহীন সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষ পুরো নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন। সুনামগঞ্জ পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যম কোন সংবাদই সংগ্রহ করতে পারছে না তাই মৃতের সংখ্যা বা ক্ষতির পরিমাণ এখন পর্যন্ত অজানা আমাদের কাছে। পরিস্থিতি ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে, সামাল দিতে সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নামাতে হয়েছে । কিন্তু এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্য অনেকে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ ও তিস্তা বাঁধকে দায়ী করছেন ।
ফারাক্কা বা টিপাইমুখ বর্তমান বন্যার জন্য আদৌ দায়ী কিনা তা জানতে হলে সবার আগে জানতে হবে এই বাঁধগুলোর অবস্থান। প্রথমত, ফারাক্কা বাঁধের সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের কোন সংযোগই নেই। ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটি বাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। বাংলাদেশ বর্ডার থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে এই বাঁধ অবস্থিত। ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিলে ভৌগলিক কারণে সবার আগে প্লাবিত হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা ও নাটোরের নিম্নাঞ্চল। কোনোভাবেই সিলেট ও নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে প্লাবিত হবে না।
টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর একটি প্রস্তাবিত বাধ । এই বাঁধ নির্মাণের কাজ বিলম্ব হচ্ছে কারণ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানির অধিকার নিয়ে অমীমাংসিত কিছু বিষয় রয়েছে। তাছাড়া এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবটাও বিবেচনায় আনতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। তো যে বাঁধই নির্মাণ হয়নি সেই বাঁধ বা তার ১১ টি গেট খুলে দেয়ার ভিত্তিহীন সংবাদ কিভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ালো। তার মানে একটা ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়েই একদল এই অপপ্রচার চালিয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তাবিত লোকেশন ভারতের মনিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে যা বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে। এই বরাক নদীর পানি সুরমা-কুশিয়ারা হয়ে মেঘনা নদীতে পতিত হয়।
তিস্তা বাঁধের সাথে সিলেট কিভাবে সম্পর্কিত তা আমার অজানা তবে যারা এই গুজবটা রটিয়েছেন তারা হয়তো জানেন! একটু ম্যাপের দিকে দৃষ্টি দিলেই দেখবেন, তিস্তা মূলত ভারতের কোন অঞ্চলে অবস্থিত। তিস্তা বাঁধের গজলডোবা নিয়েই যত বিতর্ক। এই গজলডোবা বাঁধ স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর উজানে ভারতীয় অংশে। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে। তাই তিস্তা বাঁধের কারণে যদি বন্যা হয় তবে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম সবার আগে প্লাবিত হবে। সিলেটে সাম্প্রতিক যে বন্যা হচ্ছে সেখানে এই তিস্তা বাঁধের প্রসঙ্গ আনাটাই হাস্যকর।
এবার আসা যাক সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যার মূল কারণসমূহের দিকে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে আকস্মিক বন্যার পেছনে বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত দিয়েছেন। তারা বেশ কয়েকটি কারণকে সাম্প্রতিক সিলেট বন্যার পেছনে দায়ী করছেন। ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে সেটা সিলেট বন্যার একটা বড় কারণ, চেরাপুঞ্জিতে যে বৃষ্টি হয়েছে তা এ যাবৎকালের তৃতীয় সর্বোচ্চ। বিবিসি বাংলা’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল বলছেন, ”চেরাপুঞ্জিতে যখন বৃষ্টি হয়, সেটা ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে তাহিরপুরে চলে আসে। কিন্তু সেখানে এসে পানি তো আর দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে তখন সেটা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যার তৈরি করছে,’’
এদিকে গত তিনদিন চেরাপুঞ্জিতে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে, ২৪৮৭ মিলিমিটার এবং এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম ধারাবাহিক বৃষ্টি হয়েছে ১৯৯৫ সালে একবার, তিনদিনে ২৭৯৮ মিলিমিটার আর ১৯৭৪ সালে ২৭৬০ মিলিমিটার। এরকম খুব কম দেখা গেছে। আশংকার কথা হলো, চেরাপুঞ্জিতে আরও দুই তিনদিন বৃষ্টিপাত হলে বন্যার ধকল সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি কি হবে তা বলা মুশকিল! অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের আসামেও বন্যা এবং ভূমিধ্বসের সৃষ্টি হয়েছে। আসামে বরাক ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গুয়াহাটিসহ অনেক এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। আসাম, মেঘালয় মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিচ্ছে, আসামের বন্যায় অন্তত ১১ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
[…] মৌলভীবাজার […]